সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

একটা চোর কাটা!




সার্কিট হাউজের পাশে স্টেডিয়াম। ফুটবল খেলা দেখতে প্রায়ই যেতাম সেখানে। পাশে জিপিও। স্ট্যাম্প জমানোর বাতিক ছিল। স্বাধীনতার প্রথম আটটি ডাক টিকেট সেখানকার ফিলাটেলিক ব্যুরো থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। একবার ফুটবল খেলার সময় পটকার আঘাতে এক তারকা ফুটবলার মারাত্নক আহত হয়েছিলেন। সে দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। এই স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হত। কখনও সার্কিট হাউজ ময়দানেও হত। বৃষ্টির সময় সার্কিট হাউজ মাঠে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলে মাইট্যা ভুতের রূপ হত আমাদের। এরপর নদীতে গিয়ে দস্যিপণা চলত।

সেবার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটার জন্য স্পিশাল আগ্রহ ছিল। আগেভাগেই স্টেডিয়ামে গিয়েছি। মূল প্যান্ডেলে কায়দা করে আসন বাগিয়েছি। মার্চ পাস্টে একেক দল আসছে, সালাম দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মুন্নির স্কুলের কুসুম রঙা ড্রেস পরা দল এল। মুন্নিকে দেখলাম প্যান্ডেলের কাছের লাইনে। সালাম দেয়ার সময় হঠাৎ চোখাচুখি। হেসে চোখ টিপে দিল। আমার কান গরম হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকালাম আমাকে কেউ দেখল কিনা। নাহ, এসবে কারো নজর পড়েনি। মনের ভেতর তখন শিরশিরে অনুভূতি। মার্চ পাস্টের পর স্কুলগুলোর ড্রিল। মুন্নি বেশ ভালই ড্রাম বাজাল তাদের ড্রিলের সময়। ড্রিল শেষে জটলা করে দেড়-দুইশ গজ দূরে দাড়িয়ে আছে ওরা। মুন্নিকে দেখা যাচ্ছে না। আমি প্যান্ডেলের দক্ষিণ পাশে গেলাম। হঠাৎ দেখি সে জটলার একপাশে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা চুলকানোর ভান করে সেলুট দিতেই সেও সেলুট দিল। এভাবে কয়েকবার চলল। ওরা মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি গ্যালারির ফাকা জায়গা খুজে বসে পড়লাম। আমাকে তখন যেন কি এক ভাল লাগা বিভোর করে ফেলেছে। ধীরে ধীরে মাঠ ফাকা হয়ে গেল। কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।

বিকেলে মাঠে গিয়েছি। সবাই খেলছে। আমার ইচ্ছে করছে না। হাটাহাটি করছি আর চোরা চোখে দেখছি জানালাটা খুলে কিনা। সন্ধ্যা নেমে আসছে। অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি নাকে দড়ি বাধা একটা গাধা। কিছুটা বিরক্তিও লাগছে। ধুর ছাই বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। এবার জানালা বন্ধের শব্দ পেলাম। চেয়ে দেখি বন্ধ জানালা। কয়েক পা এগিয়েছি আবার শব্দ। এবার তাকিয়ে দেখি বন্ধ। মেজাজটা পুরাই হট হয়ে গেল। জোরে পা চালালাম। দৃষ্টির শেষ সীমায় প্রায় পৌছে গেছি। নিজের অজান্তেই আরেকবার তাকালাম আড়চোখে। দেখি, জানালায় একটি দুখি মুখ। কিন্তু আমার তখন ভেতরে রাগে পুড়ছে। যেন কিছুই দেখিনি এমন ভাব করে চলে এলাম।

রাতে ঘুম আসছে না। কেবলি একটি মুখ ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। যতই না না করি, ছবিটি মুছে যায় না। বুকের ভেতর একটা অচেনা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। একসময় মনে হল একটা চোর কাটা বিধেছে বুকে। আর সেই কাটাটা হচ্ছে মুন্নী নামের একটা দুরন্ত মেয়ে।


চলবে-


১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব







[সকালে বাইক নিয়ে কাকরাইলের জ্যামে জমে আছি, তখন মুঠোফোনে একটা খবর পেলাম, আমার প্রিয় স্যার(মুন্নীর বাবা) কয়েকমাস আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমার ধারণা ছিল, হয়ত সাথে সাথে খবরটা আমাকে জানান হবে। কারণ, গত বছর স্যারকে শেষবার যখন দেখে এসেছি, আমার সেল নম্বর দিয়ে এসেছিলাম। এছাড়া আমার বিশ্বাস, মুন্নীর কাছে আমার নম্বরটা আছে। অন্তত সে ত খবরটা দিতে পারত। আজ সারাদিন ভীষণ মন খারাপ।]

এই ব্রাকেটের লেখাটুকু শুধু মুন্নীর জন্য। লেখাটা সে যখন পড়বে, বুঝতে পারবে তাকে আমি কী বলতে চেয়েছি।

 মুন্নীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা-
আমার এক ক্লাসমেট যে সংবাদটা দিয়েছিল, সেটা ভুল ছিল। তাকে আরেকজন খবরটা দিয়েছিল।

অবশেষে অনেক চেষ্টার পর জানতে পারলাম, আমার শ্রদ্ধেয় স্যার বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মুন্নীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন